সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৪৭ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক : দাদন ব্যবসায়ীর সঙ্গে এক লাখ টাকা চুক্তিতে লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চার জেলে সহযোগীদের হাতে খুন হয়েছেন। প্রথমে ঘটনাটি জলদস্যুতার বলে প্রচার হলেও নৌ-পুলিশের প্রচেষ্টায় বেরিয়ে আসে এ ফোর মার্ডারের তথ্য। আর এ কাজের মূল নিয়ামক ছিল তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বা মোবাইল ট্র্যাকিং পদ্ধতি। ক্লুহীন এ ঘটনার তথ্য উদ্ঘাটনে পুলিশ প্রথমে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়লেও পরে মুখ দেখে সফলতার। গ্রেপ্তার করা হয় ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত তিন আসামিকেও। রোববার এসব তথ্য জানিয়েছেন স্থানীয় বড়খেরী নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান।
হত্যাকা-ের শিকার ওই চার জেলে হচ্ছেন-উপজেলার চরআলেকজান্ডার ইউনিয়নের সোনালী গ্রাম এলাকার মৃত রুহুল আমিনের ছেলে নাসির উদ্দিন মাঝী (৪৫), তার ছেলে মো. রিয়াজ (১২), নোয়াখালীর চরজব্বর এলাকার আব্দুল মালেকের ছেলে মো. করিম (৪৫) ও একই এলাকার আমির হোসেনের ছেলে মো. মিরাজ (১৮)।
অপরদিকে হত্যাকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরা হচ্ছেন-চট্টগ্রামের বাকলিয়া নতুন ফিশারিঘাট এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে মো. ইউছুফ মিয়া (৩৩), যশোরের চৌগাছা উপজেলার দক্ষিণ কয়ারপাড়া এলাকার মতিউর রহমানের ছেলে মো. রাসেল (৪০) ও লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার পূর্ব চরফলকন এলাকার আবি আব্দুল্লার ছেলে আল-আমিন (৩৫)। বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড শেষে তারা এখন কারাগারে রয়েছেন।
নৌ-পুলিশ সূত্রে জানা যায়, উপজেলার চরআলেকজান্ডার ইউনিয়নের সোনালী গ্রাম এলাকার নাসির উদ্দিন মাঝী পেশায় একজন জেলে। নদী ও সমুদ্রে মাছ শিকারে তার একটি ট্রলার রয়েছে। সহযোগী জেলেদের নিয়ে নদী ও সমুদ্রে মাছ শিকার করে তিনি ঘাট এলাকার আড়তে বিক্রি করে আসছিলেন। এরই মধ্যে প্রায় ১০ মাস আগে তিনি চট্টগ্রামের বাকলিয়া নতুন ফিশারিঘাটের আড়তদার মো. ইউছুফ মিয়ার কাছ থেকে তিন লাখ টাকা দাদন নেন এবং নিয়মিত ওই আড়তে মাছ বিক্রি করছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি অভাব-অনটনে পড়ে নাসির ওই মাছঘাটের অপর এক আড়তদারের কাছ থেকে দাদন নিয়েছেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে গত ১২ মে ইউছুফ ট্রলারসহ নাসির মাঝীকে ঘাট এলাকায় আটক করে রাখলে কৌশলে ট্রলার নিয়ে তিনি পালিয়ে এলাকায় চলে আসেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ইউছুফ ট্রলারটি নিজের কব্জায় নেওয়াসহ নাসির মাঝীকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী নাসির মাঝীর ট্রলারের সহযোগী জেলে রাসেল, সুমন, সোহাগ ও আল-আমিনের সঙ্গে তিনি এক লাখ টাকায় চুক্তি করেন। তার পরিকল্পনা ও চুক্তি অনুযায়ী ১৬ মে ওই চারজন রামগতি উপজেলার স্থানীয় স্লুইজ গেট বাজারের একটি ওষুধের দোকান থেকে ঘুমের ১০টি ট্যাবলেট কিনেন। পরদিন নাসির মাঝী ও অপর তিন জেলেসহ ওই চারজন মেঘনা নদীতে মাছ শিকারে যান। নদীতে মাছ কম ধরাপড়ার অজুহাত দেখিয়ে নাসির মাঝীকে উদ্বুদ্ধ করে তারা কক্সবাজারের কুতুবদিয়া এলাকায় সাগরে মাছধরার জন্য নিয়ে যান। ইউছুফের সঙ্গে যোগাযোগ করে ২০ মে সেখানে তারা পরিকল্পনা অনুযায়ী চায়ের সঙ্গে ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে নাসির মাঝী, রিয়াজ, করিম ও মিরাজকে খেতে দেয়। চা খেয়ে তারা ঘুমিয়ে পড়লে ওই চারজন মিলে তাদেরকে সাগরে ফেলে হত্যা করে ট্রলারটি চট্টগ্রামের বাকলিয়া নতুন ফিশারিঘাট এলাকায় নিয়ে ইউছুফকে বুঝিয়ে দেয়। পরে হত্যাকারী আল-আমিন এলাকায় গিয়ে প্রচার করে জলদস্যুরা তাদের ট্রলারে হামলা চালিয়েছেন। এতে সেসহ চার জেলে পালিয়ে আসতে পারলেও ট্রলারসহ নাসির মাঝী ও তিন জেলেকে জলদস্যুরা অপহরণ করে নিয়ে গেছেন। এ খবর পেয়ে নাসির মাঝীর স্ত্রী মীরজান বেগম ২৭ মে রামগতি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
এদিকে ১৩ জুন হঠাৎ করে মীরজানের মোবাইলে রাসেল নামে এক ব্যক্তির ফোন আসে। ও প্রান্ত থেকে বলা হয় নাসির মাঝীসহ চার জেলে তার হেফাজতে রয়েছেন; এক লাখ টাকা মুক্তিপন দিলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। বিষয়টি মীরজান থানায় গিয়ে জানালে পুলিশ তাকে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেয়। পরে তার দায়ের হওয়া অভিযোগটি তদন্তের জন্য বড়খেরী নৌ-পুলিশ ফাঁড়িকে দেওয়া হয়। দায়িত্বভার পেয়ে পুলিশ মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ১৫ জুন যশোরের চৌগাছা এলাকা থেকে রাসেলকে আটক করেন। তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমেই এ ফোর মার্ডারের তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করে। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট এলাকা থেকে আল-আমিন এবং চট্টগ্রামের বাকলিয়া এলাকা থেকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ইউছুফকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইউছুফের সাত এবং রাসেল ও আল-আমিনের পাঁচদিনের করে রিমান্ড শেষে তারা এখন কারাগারে রয়েছেন।
বড়খেরী নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান জানান, এ ঘটনার প্রথমে কোনো ক্লু পাওয়া না গেলেও মোবাইল ট্র্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে রাসেলকে আটকের মধ্যে দিয়ে তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করে। পরে তিন আসামিকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে এ ফোর মার্ডারের পুরো রহস্য উদ্ঘাটন হয়। আর এ ক্ষেত্রে পুলিশের আন্তরিকতার কোনো কমতি ছিল না।
তিনি বলেন, ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত সুমন ও সোহাগকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
Leave a Reply