শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০১:০৯ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক : কাঠমিস্ত্রি বাবার অভাবের সংসারে মেজবাহ উদ্দিন (২৫) ছিলেন একমাত্র আশার প্রদীপ। খুব মেধাবী হওয়ায় চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তাকে ঘিরেই স্বপ্ন ছিল সবার। যে কারণে, চরম অভাবের মধ্যেও তার লেখাপড়ার খরচ জোগাতে আপত্তি করেননি কাঠমিস্ত্রি বাবা আবদুল অদুদ। মেজবার লেখাপড়া চালিয়ে নিতে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন পরিবারের অন্য সদস্যরাও। আর মেজবাও তাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে চেষ্টা করেছেন যথাসাধ্য। মন দিয়ে পড়াশোনা করে সকল পরীক্ষায় রাখেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর। তার স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শেষ করে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক হওয়ার। সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে পরিবারের অভাব ঘোছানোর। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। শনিবার বিকেলে রাজধানীর মগবাজারে ট্রেনে কাটা পড়ে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় মেধাবী মেজবার। এতে নিভে যায় গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের আশার একমাত্র প্রদীপটি।
পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেজবাহ ২০১১ সালে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীন লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরআব্দুল্লাহ ফাজিল মাদরাসা থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে দাখিল এবং ২০১৩ সালে হাজিরহাট উপকূল সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ-৪.৬৩ পেয়ে এইচএসসি পাশ করেন। পরে ঢাকা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে অনার্স শেষ করে একই কলেজে মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা করছিলেন। থাকতেন রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডের একটি ভাড়া বাসায়। শনিবার বিকেলে মগবাজার রেলক্রসিং ও এফডিসি রেলক্রসিংয়ের মাঝামাঝি স্থানের রেললাইন দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন মেজবাহ। এ সময় ট্রেনে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। পরে পুলিশ গিয়ে তার ছিন্নভিন্ন মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়।
এদিকে ময়নাতদন্ত শেষে মেজবার মরদেহ রোববার সকালে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ সময় মেজবার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা কলেজের প্রিয় ক্যাম্পাসে। সেখানে কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জানাজা। পরে পরিবারের সদস্যসহ মেজবার সহপাঠীরা অ্যাম্বেুলেন্সযোগে লাশ গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরআলেকজান্ডার ইউনিয়নের বালুরচর এলাকায় নিয়ে আসেন। বিকেলে তার লাশ পৌঁছানোর পর বাড়িতে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। বাবা ও ভাই-বোনসহ স্বজনদের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। একমাত্র আশার প্রদীপকে হারিয়ে শোকে মূহ্যমান পরিবারের সদস্যরা। এ সময় মেজবাকে দেখতে আসা তার সহপাঠীসহ এলাকাবাসী কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় মেজবাকে।
জানা গেছে, গত ২৬ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়ে মেজবার বড় ভাই জসিম উদ্দিন মারা যান। মাত্র সাত মাসের ব্যবধানে এখন মেজবার মৃত্যু হলো। অল্প সময়ে দুই ভাইকে হারিয়ে পরিবারটির যেন দুঃখের সীমা নেই।
সহপাঠীসহ এলাকাবসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পড়ালেখার পাশাপাশি মেজবাহ সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ছাত্রদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন সামাজিক-স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনে। ঢাকাস্থ লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্র অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মেজবাহ খুব মিষ্টিভাষি ও সদা হাস্যেজ্জ্বল ছিলেন। আত্মীয়-স্বজন, সহপাঠী, শিক্ষক ও এলাকাবাসীর সঙ্গে তার ছিল মধুর সম্পর্ক। মেজবার মৃত্যুর খবর প্রচারিত হওয়ার পর তাদের ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া মেজবাকে ঘিরে আবেগঘন স্ট্যাটাসই এর প্রমাণ-এমনটাই মনে করছেন মেজবার বন্ধুরা।
মেজবার শিক্ষক ঢাকা কলেজের সাবেক সহকারী অধ্যাপক বর্তমান ইডেন মহিলা কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু ছালেহ মোহাম্মদ নোমান তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘শিক্ষার্থীরা আমার কাছে নিজ সন্তানের মতো। ঢাকা কলেজে থাকা অবস্থায় এবং পদোন্নতির ফলে ইডেনে আসার পরেও কয়েক দিন দেখা হয়েছে; কথা হয়েছে। অন্য বিভাগের ছাত্র হয়েও অধিকার নিয়ে সলজ্জ হাঁসি দিয়ে কথা বলতো; হয়তো একই উপজেলায় দুইজনের জন্মের খাতিরে। লম্বা-উঁচু, শুভ্র বর্ণের ছেলেটি ছিল খুবই স্মার্ট। খুবই পড়–য়া ছেলেটির জীবনে অনেক স্বপ্ন ছিল বিসিএস পরীক্ষা দেবে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, দেশ ও মানুষের সেবা করবে। মাতৃবিয়োগে ক্লিষ্ট ছেলেটা কিছুদিন আগে বড় ভাইকে হারালো। কিন্তু তারপরও তার মানসিক দৃঢ়তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আজ, ও দুনিয়াতে নেই ভাবতে অনেক কষ্ট পাচ্ছি। প্রিয় মেজবাহ, আল্লাহ তোমাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন।’
মেজবার আরেক সাবেক শিক্ষক হাজিরহাট উপকূল সরকারি কলেজের আইসিটি বিষয়ের প্রভাষক মো. আক্তার হোসেন তার ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘সদা হাস্যেজ্জ্বল মেধাবী মেজবাহ আর আমাদের মাঝে নেই। অনেক সংগ্রামের পর এ পর্যন্ত আসা বিনয়ী এই শিক্ষার্থীর এভাবে চলে যাওয়া মেনে নিতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।’
শুধু এ দুই শিক্ষকই নয়; মেজবার মৃত্যুর পর এরকম অসংখ্য স্ট্যাটাস ভাইরাল হয় ফেসবুক জুড়ে।
মেজবার এলাকার জনপ্রতিনিধি চর আলেকজান্ডার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুল খালেক বলেন, ‘মেজবার মতো মেধাবী ও সদালাপি ভালো ছেলে খুব কমই হয়। তার মৃত্যুতে পুরো এলাকায় এখন শোকের ছায়া নেমে এসেছে।’
Leave a Reply