শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৪২ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক : লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ ইউনিয়নের তোঁতা মিয়া সড়ক। কাদামাটিতে বেহাল সড়কটি মেরামতের জন্য ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কাবিখা প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রায় ১২ মেট্রিক টন খাদ্যশস্যের (গম)। অথচ মাত্র ২২ জন শ্রমিক দিয়ে সামান্য মাটি ফেলে পুরো বরাদ্দ তুলে নিয়েছেন প্রকল্প সভাপতি। একই ইউনিয়নের উদয়ন হাইস্কুল থেকে পশ্চিম পাশের একটি সড়কের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯ মেট্রিক টন গম। কোনো কাজ না করে তুলে নেওয়া হয়েছে সেই বরাদ্দও। চরকাদিরা ইউনিয়নের ভূঁইয়াপাড়া জামে মসজিদের মক্তব নির্মাণের জন্য টিআর প্রকল্প থেকে বরাদ্দ দেওয়া এক লাখ ২০ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে ৩০ জুন। কিন্তু বাস্তবে সেখানে মক্তবের নেই কোনো অস্তিত্ব। শুধু এগুলোই নয়; উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে গ্রামীন অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচির আওতায় টিআর (টেস্ট রিলিফ) ও গ্রামীন অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) প্রকল্পের বরাদ্দ হরিলুট হয়েছে এভাবেই। যে কারণে কাজ না করেই প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ উত্তোলন করে আত্মসাৎ করায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এসব অনিয়ম খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন তারা।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে টিআর বিশেষ ও টিআর সাধারণের (দ্বিতীয় পর্যায়) ৩৭টি প্রকল্পের জন্য ৩৮ লাখ ৪৯ হাজার ৩৬৮ টাকা এবং কাবিখা বিশেষ ও কাবিখা সাধারণের (দ্বিতীয় পর্যায়) ১৯টি প্রকল্পের জন্য ১৩৯ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে সবগুলো প্রকল্পের সভাপতি গেল ৩০ জুনের মধ্যে বরাদ্দকৃত অর্থ ও খাদ্যশস্য তুলে নিয়েছেন। কিন্তু সরেজমিনে কয়েকটি প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে গেলে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। কিছু প্রকল্পে নামমাত্র কাজের দেখা মিললেও কাজের অস্তিত্ব চোখে পড়েনি অনেক প্রকল্পে।
জানা গেছে, তোরাবগঞ্জ ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ড এলাকার আধা কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে তোঁতা মিয়া সড়ক মেরামতের জন্য কাবিখা (সাধারণ) প্রকল্পের আওতায় ১১.৮১ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হলে প্রকল্প সভাপতি একই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল মতিন কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে পুরো খাদ্যশস্য তুলে নেন। কিন্তু ওই সড়কে চলাচলকারী স্থানীয় নুরুল আমিন, আরিফ হোসেন ও নজির আহাম্মেদসহ কয়েকজন জানান, বরাদ্দ উত্তোলনের আগে ২২ জন শ্রমিক সড়কটিতে কিছু মাটি ফেলেছেন। পরবর্তীতে আরও কিছু কাজ করা হবে বললেও এখন পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি।
নুর হোসেন নামে প্রবীণ এক ব্যক্তি জানান, সড়কটির বয়স দীর্ঘ ৫০ বছর হলেও এটির উন্নয়নে কোনো জনপ্রতিনিধি এগিয়ে আসেননি। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে বরাদ্দ আসলেও নামমাত্র কাজ করে লুটপাট করার কারণে সড়কটি দিয়ে যাতায়াতে খুব অসুবিধা হয়। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে সড়কটি যাতায়াতের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় দুর্ভোগের কমতি থাকে না।
তবে প্রকল্প সভাপতি আবদুল মতিন দাবি করেন, বরাদ্দ অনুযায়ী তিনি সব সময়ই কাজ সম্পন্ন করেছেন।
একই ইউনিয়নের চরপাগলা এলাকায় গিয়ে জানা যায়, উদয়ন হাইস্কুল থেকে পশ্চিম দিক হয়ে সেরাজল হক সড়ক পর্যন্ত একটি শাখা সড়ক বেহাল অবস্থায় থাকায় এলাকাবাসী দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ধরনা দিয়েছেন। কাজের কাজ কিছুই না হওয়ায় দেড় মাস আগে স্থানীয় ইয়াছিন আরাফাত, সোলাইমান, সফিক উল্যাহ, মো. ইউছুফ, নুর মোহাম্মদ ও আলী আজমসহ কয়েকজন উদ্যোগ নিয়ে নিজ অর্থে সড়কটিতে মাটি ফেলে চলাচলের উপযোগী করেন। কিন্তু এ সড়কটি সংস্কারের জন্য কাবিখা (বিশেষ) প্রকল্প থেকে ৯ মেট্রিক টন গম বারদ্দ হওয়ার কথা শুনে তারা হতবাক হয়ে পড়েন। অনুসন্ধানে জানা যায়, স্থানীয়দের অর্থে মেরামত করা ওই কাজ দেখিয়ে প্রকল্প সভাপতি বরাদ্দকৃত গম উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অনিয়ম খতিয়ে দেখার দাবি জানান।
এ ব্যাপারে প্রকল্প সভাপতি ছয় নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলাম বলেন, বর্ষা মৌসুম হওয়ায় সড়কটিতে কাজ করানো সম্ভব হয়নি। তবে ভবিষ্যতে কাজ করানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
উপজেলার চরকাদিরা ইউনিয়নের ভূঁইয়াপাড়া জামে মসজিদের মক্তব নির্মাণের জন্য টিআর (সাধারণ) প্রকল্প থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে প্রকল্প সভাপতি স্থানীয় ইউপি সদস্য হারুনুর রশিদ জিন্নাহ ভূঁইয়া ৩০ জুন অর্থ তুলে নিলেও বাস্তবে মক্তবের কোনো অস্তিত্ব চোখে পড়েনি।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছালেহ উদ্দিন মিঠু জানান, মসজিদের জন্য কিছু অনুদান দেওয়ার কথা বলে ইউপি সদস্য তাদের কাছ থেকে প্রকল্প কমিটিতে স্বাক্ষর নিলেও এখন পর্যন্ত অনুদান দেওয়া বা মক্তব ঘর নির্মাণ করা হয়নি।
উপজেলার চরমার্টিন ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার শামছল হক সড়ক মেরামতের জন্য টিআর (সাধারণ) প্রকল্প থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে প্রকল্প সভাপতি স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. ঈমান আলী ইতোমধ্যে অর্থ তুলে নিয়েছেন। কিন্তু স্থানীয় মো. বাহার, মো. শাহাজান ও মো. সুবজ জানান, সড়কটিতে মাত্র ২০০ থেকে ২২০ ফুট বালু ফেলা হয়েছে। এর বাইরে ওই সড়কে কোনো কাজ হয়নি।
তবে প্রকল্প সভাপতি ইউপি সদস্য মো. ঈমান আলী বলেন, কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে বিল উত্তোলন করা হলেও বর্ষা মৌসুম হওয়ায় কাজ শেষ করতে পারেননি। বর্ষা শেষে সড়কটিতে কাজ করা হবে বলে তিনি দাবি করেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. রিয়াদ হোসেন বলেন, তদারকী করেই টিআর-কাবিখা প্রকল্পের বরাদ্দ ছাড় করা হয়েছে। এর পরও কোনো প্রকল্পে অনিয়ম হয়ে থাকলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবারক হোসেন জানান, সরেজমিনে তিনি প্রকল্পগুলো পরিদর্শন করবেন এবং কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।
Leave a Reply