বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৪২ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক : অভাব ওদের নিত্যসঙ্গী; দারিদ্র্যতাই যেন নিয়তি। তবুও সেই দারিদ্র্য দমাতে পারেনি ওদের। শত প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছে তারা। কিন্তু এখন এ ভালো ফলাফলে দু’চোখ ভরা উচ্ছ্বাস থাকলেও কলেজে ভর্তি ও লেখাপড়ার ব্যয় কীভাবে মিটবে সেই দুশ্চিন্তায় প্রতিনিয়ত তাড়া করছে তাদের। তবুও প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে জীবনযুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন ওদের চোখেমুখে। সমাজের বিত্তবানদের একটু সহানুভূতি পেলেই আলোকিত মানুষ হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হতে পারে এ অদম্য মেধাবীদের।
না খেয়েও ক্লাসে যেতো এমরান
লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়নের মিয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা ফেরিওয়ালা মো. ইউছুফের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে নিয়ে ছয়জনের সংসার। সামান্য আয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা তার। তবুও সন্তানদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে পিছু হটেননি তিনি। এক ছেলে ও তিন মেয়ের সবাই পড়ছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। তাদের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে প্রতিবেশীদের কাছে প্রায়ই হাত পাততে হচ্ছে তাকে। সন্তানরাও বাবার চেষ্টার প্রতি সম্মান জানিয়ে খেয়ে না খেয়ে পড়ালেখা করে যাচ্ছে। ফেরিওয়ালা ইউছুফের সেই চার সন্তানের একজন এমরান হোসেন। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় উপজেলার হাজিরহাট সরকারি মিল্লাত একাডেমি থেকে বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পায় সে। প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ সহ বৃত্তি পাওয়া এমরান গণিত বিষয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নে মাধ্যমিকে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলো। কৃতিত্বের সহিত সেই স্তর পার করলেও এখন উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তিই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তার। কারও সহযোগিতা না পেলে হয়তো এখানেই থেমে যেতে পারে তার শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন।
এমরানের বাবা মো. ইউছুফ জানান, ভ্যানে করে বিস্কুট নিয়ে স্থানীয় বিভিন্ন বাজারে ফেরি করে বিক্রি করেন তিনি। মাস শেষে আয় হওয়া পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকায় সংসারের খরচ মেটানোই কঠিন হয়ে পড়ে তার। তবুও ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এমরান ছাড়াও তার বড় মেয়ে হাজিরহাট উপকূল সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে, মেজ মেয়ে ইবতেদায়ি সমাপনীতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে হাজিরহাট হামেদিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে এবং ছোট মেয়ে স্থানীয় একটি নূরানী মাদ্রাসায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। বাবার অসহায়ত্ব দেখে কখনও কোনো কিছুর জন্য আবদার করেনি তারা। বরং খেয়ে না খেয়ে তারা নিয়মিত পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থের অভাবে কোনো সময় সুযোগ হয়নি প্রাইভেট পড়ার।
তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি খুব আগ্রহ ছিলো এমরানের। ঘরে খাবার না থাকায় অনেক সময় না খেয়ে ক্লাসে গিয়েছিলো সে। এখন অর্থের অভাবে মেধাবী সেই ছেলের পড়ালেখা অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় বিত্তবানদের কাছে সহযোগিতা কামনা করছেন তিনি।
পুলিশ অফিসার হওয়ার স্বপ্ন বাবা হারা রিয়াজের
দারিদ্র্যতা আর নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে উপজেলার চরলরেন্স উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে রিয়াজ হোসেন। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাশ করলেও উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়া ব্যয়বহুল হওয়ায় ভর্তি হতে চাচ্ছে মানবিক বিভাগে। এতে করে অন্তত পড়ালেখাটা চলবে তার। স্বপ্ন পড়ালেখা শেষ করে পুলিশ অফিসার হওয়া।
উপজেলার তোরাবগঞ্জ ইউনিয়নের নয় নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রিয়াজ জানায়, চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বাবা মফিজুল ইসলাম মারা যান। এর পরই ঘোর অন্ধকার নেমে আসে তাদের সংসারে। তিন ভাই-বোন ও মাসহ পাঁচজনের সংসারে তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা ছিল না। চাচা ও মামাদের সহযোগিতায় কোনো রকম দিন কাটে তাদের। দুই বছর পর বড় ভাই রমিজ উদ্দিন স্থানীয় বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার সময় টিউশনি শুরু করেন। মেধাবী হওয়ায় টিউশনিতে চাহিদা বাড়তে থাকে তার। নিজের লেখাপড়ার পাশাপাশি রোজগার করা টিউশনির অর্থে সংসারের হাল ধরে রমিজ। ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে স্থানীয় একটি কলেজে এখন দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছে সে।
রিয়াজের মা লাইলী বেগম জানান, রমিজ ও রিয়াজ ছাড়াও তার ছোট মেয়ে ঋতু আক্তার স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। স্বামী মারা গেলেও স্বজনদের সহযোগিতা নিয়ে সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য ‘যুদ্ধ’ করছেন তিনি। তবে সংসারের খরচ বেড়ে যাওয়ায় রিয়াজের পড়ালেখা এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
সবজি বিক্রেতার মেয়ে ফরিদা
দারিদ্র্যতার সঙ্গে লড়াই করে তাক লাগানো ফলাফল করা আরেক শিক্ষার্থী ফরিদা আক্তার। ২০১৮ সালের জেএসসিতে জিপিএ-৫ লাভের পর এবারের এসএসসি পরীক্ষায়ও উপজেলার তোয়াহা স্মৃতি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। বাবা আবুল খায়ের সবজি বিক্রেতা হলেও ফরিদার স্বপ্ন ভালো একটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ডাক্তারি পড়ার।
ফরিদা জানান, উপজেলার চরলরেন্স এলাকায় তার পৈত্রিক বাড়ি ছিলো। অভাব-অনটনে পড়ে নয় বছর আগে বাড়িটি বিক্রি করে মিয়াপাড়া এলাকার নানার বাড়িতে উঠেন তারা। মা, দুই ভাই ও দুই বোনসহ ছয়জনের সংসারের খরচ মেটাতে তারা বাবা কুমিল্লা শহরে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি শুরু করেন। বাবার সামান্য সেই আয়ে টেনে-টুনে চলছে তাদের সংসার। জেএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ায় তার প্রতি স্কুলের শিক্ষকদের ছিলো ভিন্ন নজর। অর্থের অভাবে প্রাইভেট পড়ার সুযোগ না পেলেও শিক্ষকরা তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। এখন উচ্চমাধ্যমিকে সেই রকম সহযোগিতা না পেলে হয়তো তার লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
ফরিদার বাবা আবুল খায়ের জানান, সবজি বিক্রির সামান্য আয় দিয়ে সংসার চালানোসহ তিন সন্তানকে তিনি লেখাপড়া করাচ্ছেন। এখন ফরিদার স্বপ্ন একটি ভালো কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়া। তার লেখাপড়া চালিয়ে নিতে যে অর্থের প্রয়োজন হবে; তা সংকুলান করা তার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। তাই মেয়ের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণে বিত্তবানদের হাত বাড়িয়ে দিতে অনুরোধ জানান তিনি।
Leave a Reply