শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:১৪ অপরাহ্ন

ইলিশের জীবন রহস্য উদঘাটনে নতুন দিগন্তের সূচনা

নজরুল মৃধা:
ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। ভৌগোলিক নির্দেশক অর্থাৎ জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধন স্বীকৃতির পর বিশ্বে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশের জীবনরহস্য বা জিন নকশা (জিনোম সিকোয়েন্স) উদ্ঘাটন করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক। এটা বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে গর্বের বিষয়। কারণ ইলিশে রয়েছে আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য। ইলিশ বাঙালির রক্তে-মাংসে মিশে রয়েছে। তাই এই সাফ্যলের পথ বেয়ে সুন্দর আগামী গড়তে হবে।

ইলিশের জীবন রহস্যের উদঘাটন দলের নেতা ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলম গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, আমরা ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছি। জিনোম সিকোয়েন্সিং হচ্ছে- কোন জীবের জিনোমে সমস্ত জৈবঅণুসমূহ কীভাবে সাজানো তা জানা। জিনোম হচ্ছে একটি জীবের পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। এই তথ্য ব্যবহার করে পরবর্তীতে আমাদের কাঙ্খিত গবেষণা করে ইলিশের সামগ্রিক উন্নয়ন করতে পারব। এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এ জন্য আরও গবেষণা করতে হবে। তিনি গণমাধ্যমকে আরো বলেন, ইলিশের জীবনরহস্য পুরোটাই আমরা নিজেরা করেছি, কোনো বিদেশি গবেষকের সহায়তা ছাড়া। ফলে পরবর্তীতে এ নিয়ে আরও কাজ করতে সহজ হবে। যা অন্য প্রজাতির ক্ষেত্রে কম সুযোগ ছিল। ফলে ইলিশের জীবনরহস্য উন্মোচনের সুফল জাতি পাবে। এখন ইলিশের ব্যাপারে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়, গবেষণা করে ইলিশের জিন প্রয়োজনে পরিবর্তন করে চাষ উপযোগীসহ কাঙ্খিত সব পরিবর্তন সম্ভব। এটি এক সময় পুকুরেও চাষ করা যাবে।

ইলিশের জীবন রহস্য উদঘাটনের মূল প্রজেক্টের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতকরণ শুরু হয় ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। এরপর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের (এনসিবিআই) তথ্য ভাণ্ডার থেকে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট স্বীকৃতি পায়। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে দুটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে গবেষণার বিষয় উপস্থাপন করা হয়। ধারাবাহিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই জাতির সামনে গবেষণা কার্যক্রম উন্মোচন করেন গবেষক দল। এই সাফল্য শুধু বাংলাদেশের নয়। এটা বিশ্বের অর্জন। এর আগে ভৌগোলিক নির্দেশক অর্থাৎ পণ্য হিসেবে নিবন্ধন স্বীকৃতি পেয়েছে আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ। এখন থেকে ইলিশ বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে বিশ্বে পরিচিত হবে। হাজার বছর ঐতিহ্য ধারণ করে অবশেষে এই ইলিশ আমাদের নিজস্ব সম্পদ হলো। খুব দ্রুত আনুষ্ঠানিকভাবে মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষের কাছে ইলিশের জিআই নিবন্ধনের সনদ তুলে দেয়া হবে বলে জানিয়েছে পেটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদফতর। তবে প্রশ্ন জাগে, ইলিশ কি আগে আমাদের নিজস্ব সম্পদ ছিল না। শতশত বছর আগে থেকে লালন করা ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেতে এত লম্বাপথ পাড়ি দিতে হলো কেন? তবে ইলিশের স্বীকৃতির সাথে এর শতপদের রসনাতৃপ্তি করা রান্নার স্বীকৃতিটা পেলে আরো ভালো হতো।

তিন থেকে চার দশক আগেও আমরা হাট বাজারে মাইকিং করে ইলিশ মাছ বিক্রি করতে দেখেছি। ধনী, গরিব সকলেই ইলিশের স্বাদ প্রাণ খুলে নিত। বাজারে গেলে ক্রেতারা হালি হিসেবে দরদাম করতো। সুস্বাদু ইলিশের রূপ গন্ধে বিমোহিত হতো না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর ছিল। ১৯৮৩ সালে পাকশি গিয়েছিলাম। তখন ট্রেন ছাড়া যোগাযোগের মাধ্যম ছিল একমাত্র ফেরি। ওপাড়ে ফেরি থাকলে এপাড়ের মানুষকে ঘণ্টাখানেকের বেশি অপেক্ষা করতে হতো। অপেক্ষার এই সময়টুকুতে নদীর দুই পাড়ের হোটেলগুলোর কর্মচারীরা হাঁকডাক শুরু করে দিতেন পদ্মার টাটকা ইলিশ খাওয়ার জন্য। সেসময় আমি মাঝারি সাইজের পুরো একটি ইলিশ মাছ ভাজা খেয়েছিল মাত্র ১৩ টাকায়। ১৯৮৩ থেকে ২০১৮ সাল। মাঝখানে ফারাক ৩৫ বছর। এই সাড়ে তিন দশকে পাল্টে গেছে ইলিশের চেহারা, দাম ও স্বাদ। ইলিশ এখন চলে গেছে কল্পনার জগতে। এর বহুবিধ কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম জলবায়ুর পরিবর্তন, পদ্মায় ভারত কর্তৃক ফারাক্কার বাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর নবত্যা হারিয়ে স্রোতের গতি কমে যাওয়া।

জানা গেছে, মৎস্য অধিদফতর রূপালি ইলিশকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য পেটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতরে আবেদন করে। এরপর বিষয়টির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলতি বছরের ১ জুন গেজেট প্রকাশ করা হয়। প্রচলিত আইন অনুযায়ী গেজেট প্রকাশিত হওয়ার দুই মাসের মধ্যে দেশ বা বিদেশ থেকে এ বিষয়ে আপত্তি জানাতে হয়। কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে আপত্তি জানাননি। ফলে ইলিশের স্বত্ব অর্থাৎ মালিকানা লাভ করেছে বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৬৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। এছাড়া ভারতে ১৫ শতাংশ, মিয়ানমারে ১০ শতাংশ, আরব সাগর তীরবর্তী দেশগুলো এবং প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগর তীরবর্তী দেশগুলোতে বাকি ইলিশ পাওয়া যায় । বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের আসামের ভাষায় ইলিশ শব্দটি পাওয়া যায়। ওড়িয়া ভাষায় একে বলা হয় ‘ইলিশি’। তেলেগু ভাষায় ইলিশকে বলা হয় ‘পোলাসা’। গুজরাটে স্ত্রী ইলিশ ‘মোদেন’ ও পুরুষ ইলিশ ‘পালভা’ নামে ডাকে। বার্মিজরা ডাকে ‘সালাঙ্ক’ বলে। বাংলাদেশের পদ্মা, যমুনা, মেঘনা ও কর্ণফুলি ছাড়াও ইলিশ পাওয়া যায় শাতিল আরব, ইরান, ইরাকের টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস, পাকিস্তানের সিন্ধু, মিয়ানমারের ইরাবতী এবং ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীর মিঠা পানিতে। বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে উত্তর উপকূল ছুঁয়ে পশ্চিমে ভারত সাগর হয়ে আরব সাগর, লোহিত সাগর পর্যন্ত দেখা যায় ইলিশের বিচরণ। আরব সাগর থেকে উত্তরে ওমান ও হরমুজ প্রণালী হয়ে পশ্চিমে পারস্য উপসাগরেও মেলে ইলিশের ঝাঁক। বঙ্গোপসাগর থেকে আন্দামান সাগর আর মালাক্কা প্রণালী হয়ে চীন সাগরেও ইলিশ দেখা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি মাছ পাওয়া যায় আমাদের দেশে তার প্রমাণ এই স্বীকৃতি। বাংলাদেশে পাওয়া যায় মোট তিন প্রজাতির ইলিশ।

ইলিশ সামুদ্রিক মাছ, ডিম পাড়ার জন্য বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতের নদীতে আসে। বাঙালিদের কাছে ইলিশ খুব জনপ্রিয় ও উপাদেয় খাদ্য। এ ছাড়াও ইলিশ খাদ্য হিসেবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা, আসামেও খুব জনপ্রিয়। ইলিশ অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মাছ। বঙ্গোপসাগরের ব-দ্বীপাঞ্চল, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর মোহনার হাওর থেকে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। এটি সামুদ্রিক মাছ কিন্তু এর বৈশিষ্ট্য হলো এই মাছ বড় নদীতে ডিম দেয়। ডিম ফুটে গেলে ও বাচ্চা বড় হলে ইলিশ মাছ আবার তার গন্তব্য সাগরে ফিরে যায়। সাগরে ফিরে যাবার পথে জেলেরা এই মাছ ধরে। জীবনচক্র পূর্ণ করতে ডিম ছাড়ার সময় হলে ফের উঠে আসে নদীর অগভীর পানিতে। ঘণ্টায় ৭১ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে ইলিশ। ডিম ছাড়ার জন্য এরা ১২শ কিলোমিটার পানিপথ পাড়ি দিতে পারে অনায়াসে। তবে গভীরতা ৪০ ফুট হলে সাঁতরাতে সুবিধা হয় ওদের। উজানে চলার সময় কিছু খায় না এরা। ডিম ছাড়ে সাঁতরিয়ে সাঁতরিয়ে। একেকটি মাছ ডিম ছাড়তে পারে ২০ লাখ পর্যন্ত। সারা বছর ডিম দিলেও সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেই সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে ইলিশ। ইলিশ মাছ ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। বড় ইলিশের ওজন হয় আড়াই কেজি পর্যন্ত। পুরুষের চেয়ে স্ত্রী ইলিশ আকারে বড় হয়। বাড়েও দ্রুত। মাত্র ১ থেকে ২ বছরের মধ্যেই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যায় ইলিশ মাছ। দেশে ধরা পড়া মোট মাছের ৬ থেকে ৭ ভাগের ১ ভাগ এই ইলিশই। এ মাছ ধরা ব্যবসায় নিয়োজিত রয়েছে দেশের প্রায় ২০ লাখ মানুষ।

বেশ কয়েক বছর থেকে প্রজনন মৌসুমে নদীর মোহনায় সরকারের কঠোর নজরদারির ফলে মা মাছ ধরা কমে যাওয়ায় সম্প্রতি ইলিশের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তবে ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তন ও পানি কমে যাওয়ায় ডিম ছাড়ার জন্য উজানে পরিযায়ী হওয়ার আগেই ইলিশ ধরা হচ্ছে। স্লুইস গেট নির্মাণ করে কুমার নদ বন্ধ করে দেয়ায় নষ্ট হয়ে গেছে সমুদ্র থেকে নবগঙ্গা হয়ে পদ্মায় যাওয়ার পথ। ফলে ইলিশের বংশ বিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া চাঁদপুর সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প এবং মেঘনা-ধনাগোদা সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প জাটকা ইলিশের বিচরণ এলাকা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় ইলিশ প্রজননের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব আরো বেড়েছে বলে মৎস্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

অনেক বাঙালি হিন্দু পরিবার বিভিন্ন পূজার দিনে জোড়া ইলিশ ক্রয় করেন। সরস্বতী পূজা ও লক্ষ্মীপূজায় জোড়া ইলিশ কেনা খুব শুভ লক্ষণ হিসেবে মনে করেন তারা। হিন্দুশাস্ত্র মতে বিষ্ণুর দশ অবতারের প্রথম অবতার হলো মৎস্য। বিষ্ণুধর্মসূত্রে মৎস্য নিধনকারী, মৎস্য চোরদের জরিমানার ব্যবস্থা ছিল। মনুস্মৃতিতে মাছ চুরিতে দ্বিগুণ দণ্ডের ব্যবস্থা ছিলো। দ্বাদশ শতকের বিভিন্ন রচনাতেও ইলিশের বিবরণ পাওয়া গেছে। অশোকের পঞ্চম স্তম্ভলিপিতে বছরে ৫১ থেকে ৭২ দিন ডিমওয়ালা স্ত্রী মাছ, ছোট মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক এবং পৌষ মাসের শুক্লা চতুদর্শী, পূর্ণিমা এবং পূর্ণিমার পরদিন, অমাবস্যা ও অষ্টমীর দিনগুলোতে বছরে কমপক্ষে ৫২ দিন থেকে ৭২ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিলো সেই আদি যুগ থেকেই। কিন্তু আমরা প্রায় বারো মাসই ইলিশ ধরে তার বংশ ধ্বংস করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

নিউজটি শেয়ার করুন:


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2018 Priyo Upakul
Design & Developed BY N Host BD
error: Content is protected !!